Camtasia Studio 9 Video Editing Full Bangla Tutorial
আমার ফোনের ওয়ালপেপারে নিজের ছবি দেখে রাগে ফুঁসে উঠলেন শায়লা আপু। শক্ত হাতে আমার কান টেনে ধরে বললেন, "এটা কী, হুম? আমার ছবি তোমার ফোনে কেন?"
যার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই ভয় লাগে তাঁকে কীভাবে নিজের ভালোবাসার কথা বলি? তাই আমি চুপ করে রইলাম। সত্যিটা বলার সাধ্য আমার কোনোদিনই হবে না। কারণ আপু আমার চেয়ে কমসেকম চার বছরের বড়ো। তার উপর তিনি আমাকে পড়ান। শিক্ষিকার সাথে ছাত্রের এই অসংগত সম্পর্ক কি কেউ কোনোদিন মেনে নেবে? অবশ্যই নেবে না। তাই আমি চুপ থাকি। দীর্ঘদিন বুকের ভেতরে লালন করা কোমল ভালোবাসাটুকু আড়ালেই রেখে দেই।
আপু এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে। আর আমি ইন্টারে ভর্তি হয়েছি। বয়সের এই ব্যবধানের কথা আমি সেদিনই ভুলে গিয়েছিলাম, যেদিন আপু আমার হাত ধরে অনেক্ষণ হেঁটেছিল। তবে আপুর মনে সেরকম কিছু ছিল না। বখাটেদের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য ট্রিকস্ করেছিল মাত্র। কিন্তু সেই সামান্য স্পর্শ যে আমাকে এতটা বদলে দেবে তা কে জানত! সেই একটুক্ষণের পথচলা যে আমাকে এতটা উন্মুক্ত করে তুলবে সেটাই বা কার ধারণায় ছিল?
আপু আমার ফোনটা টেবিলের উপর রেখে বললেন, "এজন্যই দিনদিন পড়াশোনার অবনতি হচ্ছে। আজ আন্টি চা নিয়ে আসুক। উনার কাছেই বিচার দেব। দেখি উনি কী করে।"
মিনিট কুড়ি পর আম্মু চা-বিস্কিট নিয়ে রুমে আসলেন। শায়লা আপু প্রথমেই আমার ফোনটা আম্মুকে দেখিয়ে বলল, "দেখেন আন্টি। আপনার ছেলে তার ওয়ালপেপারে আমার ছবি টানিয়ে রাখছে। এই বয়সেই যদি সে এমন হয়..."
আপু ভেবেছিল আম্মু আমাকে শাসন করবে। কিন্তু আম্মুকে আমি আগে থেকেই সবকিছু বলে রেখেছি। আম্মু আমার সব কথা জানে। তাই বিনীত হেসে আলতো করে শায়লা আপুর হাত ধরল। বলল, "তুমি তো জানো মা, আমার ছেলেটা একটু পাগল টাইপ। তবে মানুষ হিসেবে সে খুবই ভালো। যদিও বয়সে তোমার থেকে তিন-চার বছরের ছোটো হবে। কিন্তু বয়স তো আর স্থির থাকে না। দিনদিন ওর বয়স বাড়বে। আর ভবিষ্যতে সে যদি চাকরিবাকরি না-ও পায় তবুও তার বাবার যা আছে তাই দিয়ে জীবন পার করে দিতে পারবে। আরজু আমার একটামাত্র ছেলে। সে যদি জীবনসঙ্গী হিসেবে তোমার মতো লক্ষ্মী কাউকে বেছে নিতে চায় তবে আমি কখনোই আপত্তি করব না।"
কথাগুলো শুনে শায়লা আপুর চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আম্মু পরনের সোনার চেন খুলে শায়লা আপুর গলায় পরিয়ে দিতে দিতে বললেন, "এটা আমার তরফ থেকে উপহার। তোমার তো মা নেই। ধরে নিও তোমার দ্বিতীয় মা তোমাকে এই চেন গিফট্ করেছে।"
খেয়াল করলাম আপুর চোখদু'টো টলমল করছে। নিশ্চুপ থেকে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছেন তিনি। মা বেরিয়ে যাওয়ার পর আপু আর কিছু বলেননি। তবে সন্ধ্যের পর তিনি আমার নাম্বারে ফোন দিলেন,
"আরজু?"
"জি, আপু।"
"তোমার আম্মুকে বলে দিও কাল থেকে আমি আর তোমাকে পড়াতে পারব না।"
কথাটা শুনতেই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল আমার। সহসা প্রতিবাদী সুরে বললাম, "কেন পড়াবেন না?"
"সামনে আমার থার্ড ইয়ারের পরীক্ষা তাই।"
"তাহলে পরীক্ষা শেষ হলে আবার পড়াবেন?"
"না। আমি আর কোনোদিন তোমাকে পড়াতে যাব না। সেটা তোমার আম্মুকে বলে দিও। আর হ্যাঁ, তুমি একবার আমাদের বাসায় এসে তোমার মায়ের চেনটা নিয়ে যেও।"
"কিন্তু সেটা তো আম্মু আপনাকে গিফট্ করেছে!"
"আমি কারোর গিফট্ রাখি না। তুমি একবার এসে নিয়ে যেও।"
পরদিন বিকেলে চেন আনতে গিয়ে দেখি শায়লা আপু এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। লোকটার বয়স পঁয়ত্রিশের কম হবে না। আর আপুর বেশি হলে বাইশ। লোকটা দেখতে খাটো এবং ভুঁড়িওয়ালা। অপরদিকে আপু চিকন আর লম্বা। লোকটা কালো আর আপু ধবধবে ফরসা। তাদেরকে একসাথে দেখে মনে হলো যেন, দু'জন দুই দেশের মানুষ। আপু ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার। আর ওই লোকটা নাইজেরিয়া বা উগান্ডার। সে আলগোছে একবার আপুর হাতও ধরে ফেলেছিল। তাই দেখে আমার এতটাই রাগ হলো যে, ইচ্ছে করছিল হাতের কাছে যা পাই তাই দিয়ে তার মাথা ফাটাই। কিন্তু আপুর ভয়ে সেটা আর করিনি।
আপু আমাকে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন। আম্মুর দেওয়া চেনটা বের করে দিয়ে বললেন, "আমার ছবিটা ডিলিট করে দিও।"
আমি ভয়ে ভয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। তিনি আজ মেহেদি রঙের শাড়ি পরেছেন। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকের প্রলেপ। মুখে প্রসাধনীর নামমাত্র ছোঁয়া। তাঁকে দেখতে কী যে দারুণ লাগছে তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমার ইচ্ছে করছিল তাকিয়েই থাকি। আর কোনোদিন চোখ না ফেরাই। পলক না ফেলি। একটা জীবন তাঁকে দেখেই পার করে দেই।
"আপনি আমার ভুলের জন্য টিউশানি ছেড়ে দিচ্ছেন, না?"
আপু আঁড়চোখে তাকালেন। কিছু বললেন না। আমি শুকনো গলায় জানালাম, "আমি এখনই ওয়ালপেপার থেকে আপনার ছবি মুছে ফেলব। তবুও আপনি আমাকে পড়ানো বাদ দেবেন না প্লিজ।"
"তুমি আমাকে ভালোবাসো?"
আপুর মুখে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা শুনে গলায় কাঁপন ধরে গেল আমার। আমি তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারলাম না। আপু ফের বলল, "বাসো কি না?"
"বাসি।"
"কতটা?"
"অ-অনেকটা।"
আপু ফিসফিসিয়ে বলল, "আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে?"
কথাটা শুনে আমি হতবাক হয়ে যাই। উনিশ বছর বয়স আমার। এত কম বয়সে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলব! না, তা কী করে হয়? আপুর প্রশ্নের জবাবে না বলে দিতেই আপু বিষণ্ন গলায় বলেন, "তাহলে আজ এই কালো, ভুঁড়িওয়ালা লোকটাকে কবুল করে চলে যেতে হবে।"
"আজ?" আমি বিস্মিত চোখে তাকাই। আপু ম্লান হেসে বলে, "হুম। কী কপাল আমার! এতটুকু পড়াশোনা করে শেষে কিনা ফাইভ পাস লোকের সাথে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তা-ও যে লোকটা আগেও একবার বিয়ে করেছিল!"
আপুর চোখদু'টো টলোমলো করছে। আমি আপুর পারিবারিক বিষয় কিছুটা জানি। আপু ছোটোবেলায় মা-বাবা হারিয়েছে। তারপর মামার বাড়িতেই সে বড়ো হয়েছে। ইদানীং মামি আপুকে খুব অত্যাচার করে। আপু টিউশানি করে যা পায় সব নিয়ে নেয়। আপুকে দিয়ে বাসায় সব কাজ করায়। গত মাসে আপু টিউশানির টাকা দেয়নি বলে মামি তাকে খুব মেরেছে। এবার হয়তো উনি টাকার জন্য আপুকেই বিক্রি করে দিচ্ছে!
আপুর চোখদু'টো ঝাপসা। তিনি ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, "বাড়ি যাও। আমার জন্য দোয়া করো। যেন খুব শীঘ্রই এই নরকের জীবন থেকে মুক্তি পাই।"
আমার খুব কষ্ট লাগছে। আপুর চোখে জল দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারছি না। আপু কাঁদছে। দু'হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। এমন সময় মামি এসে আপুর ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন। ভারী গলায় বললেন, "এই শায়লা, তোকে না কখন রেডি হয়ে আসতে বলছি? এতক্ষণ লাগে কেন তোর? কাজী সাহেব চলে এসেছে। এক মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে আয়।"
"আমি এই বিয়ে করব না।" কান্নাভেজা কণ্ঠে প্রতিবাদ করে উঠল শায়লা আপু। মামি সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে এসে আপুর গাল বরাবর ঘুসি মেরে বললেন, "আবার আমার মুখের উপর কথা কয়!"
আপু হুহু করে কাঁদছে। মামি গজরাতে গজরাতে বেরিয়ে গেছেন। আমি একটু দূরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এই মুহূর্তে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে আমার। যাকে এতটা ভালোবাসি তাকে কাছ থেকে কষ্ট পেতে দেখছি অথচ কিছু করতে পারছি না। এদিকে আপু কেঁদেই চলেছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে আপুর হাত ধরে পালিয়ে গেলেই ভালো হবে। এতে অন্তত আপু রক্ষা পাবে। পরে নাহয় বয়স হলে বিয়ে...
চলবে
গল্প : ভালোবাসা বাকি আছে
পর্ব : এক
লেখক : মো. ইয়াছিন