বকেয়া মজিদ | Bokaya Mojid
গল্প: #নিকাহ
তৃতীয় পর্ব (শেষ পর্ব)
তানহা চিনিশপুরে তার বাবার বাড়ি চলে গেল। বাঁধা দিয়ে রাখতে পারিনি। কাল গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। জানি না কীভাবে তার অভিমান ভাঙবে। ফারজানার সাথে দেখা না হলে এতকিছু হতো না। প্রাক্তন অনুপস্থিতীতে যেমন কষ্ট দেয়। উপস্থিতীতেও কষ্টু অনুভূত হয়। কষ্টের অনুভূতির আরেক নাম প্রাক্তন।
বাবা বাড়ি নেই। গেছে হয়তো কোথাও। মিতু চলে গেছে তার শ্বশুর বাড়িতে। আমারও আজ কোনো কাজ নেই। পুরো বাড়িতে আমি একা। আমার মনের ভিতর যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কারও কাছে বলে যে একটু হালকা হবো, তেমন কেউ নেই।
হঠাৎ বাবার কথা মনে হলো। দেড় বছর আগে বাবা বলেছিল, "আমার মতো তুইও যেদিন একা হবি, তখন আমার কষ্ট বুঝতে পারবি।"
আমি সত্যিই এখন বুঝতে পারছি। একাকীত্ব মানুষকে কত কষ্ট দেয়।
সন্ধ্যা লগনে আমি বিছানায় কাত হয়ে আছি। অদূরে মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। এমন সময় শুয়ে থাকা অনুচিত। উঠে নামাজ পড়ে নেয়াটা উত্তম। বাইরে বের হয়ে নলকূপ থেকে ওযূ করার সময় বাবা বাড়িতে ফিরলেন। আমাকে দেখে বললেন, "নামাজ পড়া শেষ করে একটু শুনে যাস তো।"
আমি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। আমার ওযূ শেষ হলে তিনি শুরু করবেন।
নামাজ শেষ করে বাইরে বের হয়ে দেখি বাবা ঘর থেকে বের হচ্ছেন। কাঁচা পাকা দাঁড়িতে বাবার বয়স বুঝা দায়। পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশের মাঝামাঝি হতে পারে। আমি কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি। বাবা আমাকে উদ্দেশ্য করে অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, "আজ না ডাক্তার দেখাতে গেলি। কী বলেছে ডাক্তার?"
আমি জবাবে বললাম, "কোনো সমস্যা নেই বাবা। ডাক্তার বলেছে, আমরা শীঘ্রই সুসংবাদ পেতে পারি।"
-ভালো কথা। বউ-মা কই?
-তানহা চিনিশপুরে গেছে। বাবার বাড়িতে।
-হঠাৎ বাবার বাড়িতে কেন? আর তোকে ছাড়া গেল কীভাবে?
-আমি এগিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। বলল, বাড়ির কথা মনে পড়ছে। তাই আর কিছু বলিনি। আমি যাইনি, কারণ সকালে পোগ্রাম আছে আমার।
বাবা আর কিছু বলেননি। আমি সকালেই রওনা হবো চিনিশপুরে।
রাত আনুমানিক কয়টা বাজে আমি জানি না। বুঝা যাচ্ছে মধ্য রাত। চারিদিকে নীরবতা আসন পেতে বসেছে। আমার আঁখি দ্বয়ে নিদ্রা নেই। বাছানায় গড়াগড়ি করছি। কী যেন নেই, কী যেন নেই! তানহার সাথে আমার দেড় বছরের সংসার। অথচ তার জন্য কী এক মায়া জন্মেছে আমার। একা থাকার কারণে ঘুম পাচ্ছে না। একটা রাতও পেরিয়ে যায়নি। অথচ একা থাকার কারণে বিছানায় কেমন ছটফট করছি। অথচ আমার বাবা সাড়ে তেরো বছর একা একা এই দীর্ঘ রজনী পাড়ি দেন। দেড় বছর আগে বাবা একাকীত্ব ঘুচাতে বিয়ে করতে চাইলেন। আমি বাঁধা দিলাম। বোনকে ফোন করে এনে দল ভারী করলাম। লোকে কী বলবে, সমাজ কী বলবে ভাবলাম। কিন্তু একা একটি মানুষের দিনরাত কেমন করে কাটে সেটা কেন ভাবলাম না? সমাজ কি আমাদের মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে? একাকীত্ব ঘুচাতে পারে?
এই কথাগুলো কেন আগে বুঝলাম না? কেন যেন মনে হচ্ছে বাবার সাথে অন্যায় করেছি। শুধু বিয়ে করার অনুমতি নয়, নিজে তদারকি করে বাবাকে বিয়ে করানো প্রয়োজন ছিল। আজ বিছানায় একা হওয়ার পর তা হারে হারে টের পাচ্ছি।
শ্বশুরের নাম সামসুল হক। দোলনায় দোলে বই পড়ছেন। আমার দেড় বছরের বৈবাহিক জীবনে তিনি একবার গিয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে। এত বই পড়তে পারে মানুষটা!
আমাকে ঢুকতে দেখে বসা থেকে উঠলেন। দোলনায় বই রেখে এগিয়ে এলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "বাবা শাওন, তুমি আমার সাথে এখানে বসো কিছুক্ষণ। তানহার রাগ এখন চরমে। ঘরে যাওয়া বিপদজনক। তোমার শাশুড়ি যখন রাগ করত, আমি চায়ের দোকানে গিয়ে বসে থাকতাম। আসো, বসো এখানে।"
আমি কোনো কথা না বলে শ্বশুর মশাইয়ের সাথে গিয়ে দোলনার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আবার বললেন, "কাল থেকে এখনো পর্যন্ত ভাত খায়নি। খুব রেগে আছে। ওর খালা পর্যন্ত খাওয়াতে পারেনি। বসো এখানে। এখন যাওয়ার দরকার নেই।"
আমি বসার সাহস পাচ্ছি না। হঠাৎ চোখ পড়ল ছাদের দিকে। তানহার খালা হাত ইশারায় আমাকে ডাকছে। দৃশ্যটি আমার শ্বশুরের চোখ এড়ায়নি। তিনি বললেন, "যাও, তানহার খালার সাথে যেতে পারো।"
আমি যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম।
এই রুমটি তানহার খালার। পরিপাটি একটি রুম। আমি বসে আছি চেয়ারে। তানহার খালা বলল, "যেহেতু রাগ করে এসেছে, দুয়েকটা দিন থেকে যাক। তুমিও নাহয় থাকো। দুয়েকদিন পরে তানহাকে সাথে করে নিয়ে যেও।"
-খালা, রাগ করার মতো তেমন কিছু ঘটেনি।
-তানহা বলেছে আমাকে। তুমি না-কি আগের সম্পর্কের কথা গোপন করেছো।
-সে কখনো জানতে চায়নি, আমিও ইচ্ছে করে কিছু বলিনি। এই সাধারণ বিষয়টা নিয়ে এতটা রেগে যাবে ভাবিনি।
-চিন্তা করো না বাবা, আমি ওকে বুঝাব।
এমন সময় তানহার আগমন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, "মা, তুমি ওকে চলে যেতে বলো। আমি যাব না ওর সাথে।"
কথাটুকু বলে স্থান ত্যাগ করল। আমি প্রসঙ্গ পালটাতে বললাম, "খালা, তানহা আপনাকে মা বলে ডাকে?"
-বেশিরভাগ সময় মা ডাকে। হঠাৎ হঠাৎ খালা ডাকে।
-তাহলে আমিও আপনাকে মা ডাকি? আমারও তো মা নেই।
-অবশ্যই ডাকবে, আমি তো তোমার মায়ের মতোই।
-আপনি আমার সত্যিকারের মা হবেন?
তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, "বুঝলাম না বাবা।"
-না মা, কিছু না। আমি আজ তাহলে আসি। তানহা আজ যাবে না, বুঝাই যাচ্ছে।
-থেকে যাও আজকে। তানহার সাথেও তো কথা বললে না।
-না থাক। কাল পরশু নাহয় আসব।
বাইরে বেরিয়ে আসতেই শ্বশুর মশাই ডাকলেন। এগিয়ে গেলাম। তিনি জানতে চাইলেন, "রাগ কিছুটা কমেছে?"
আমি ঘাড় নাড়লাম। তিনি আবার বললেন, "জানতাম। রাগটা ঠিক ওর মায়ের মতো।"
-ঠিক আছে বাবা, আমি আজ আসি তাহলে। জরুরী কাজ আছে। কাল পরশু নাহয় আরেকবার আসব।
-আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার বাবাকে আমার সালাম দিও।
আমি শ্বশুর মশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসতে যাব। পেছন ফিরে দেখি তানহার খালা দাঁড়িয়ে আছে। যাকে মা বলে ডাকার অনুমতি পেয়েছি। চেহারার দিকে তাকালেও মায়ের মতো অনুভূতি তৈরী হয়। আমার হঠাৎ কী যেন হলো! আমি গেইট পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে পারিনি। ফিরে গেলাম মায়ের কাছে। তিনিও কিছুটা অবাক হলেন। আমি গিয়ে উনার হাত ধরলাম। বললাম, "মা, বেয়াদবি নিবেন না। তখন কথাটি বলতে হিয়ে থেমে গিয়েছি। আমি কথাটা আবার বলতে চাই।"
মায়ের চেহারায় বিষ্ময়। তিনি বললেন, "কী কথা বাবা?"
-মা, তানহাকে আপনি ছোটো থেকে মায়ের আদর দিয়ে বড়ো করেছেন। সে আমাদের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে আপনি একা হয়ে গেছেন। তানহা নিজেও আপনার কথাই বলতে থাকে। আমি বাড়িতে না থাকলে একা থাকে। বলছিলাম কি! আমারও মা নেই। তানহা এই বাড়িতে মা রেখে আমাদের বাড়ি বউ হয়ে গেল। আপনিও আমাদের বাড়িতে চলেন। আপনার দুইটা সন্তানের কাছে থাকবেন। আপনি আমার সত্যিকারের মা হয়ে যান।
তিনি এক কদম পিছিয়ে গেলেন। বললেন, "এসব কী বলছ বাবা? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এটা সম্ভব নয়।"
-কেন সম্ভব নয় মা? আপনি একটু ভেবে দেখেন। আপনি আমাদের বাড়িতে গেলে আমরা দুইজন মা'কে কাছে পাব।
তিনি আর কোনো কথা না বলে ঘরে চলে গেলেন। আমিও আর দেরি করিনি। মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে।
পরেরদিন দুপুরে আমি আর বাবা একসাথে বসে ভাত খাচ্ছি। একটু পর পর বাবার চেহারার দিকে তাকাই। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা আমাকে আর মিতুকে আগলে রেখেছেন। নিঃসঙ্গ একাকী হয়ে গেছে মানুষটা।
-কী হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
বাবার কথা শুনে যেন বাস্তবে ফিরে এলাম। হঠাৎ বলে ফেললাম, "বাবা তুমি এবার একটা বিয়ে করো।"
আমার কথা শুনে বাবা মুখের ভাত চিবাতে দেরি করছেন। প্লেটের ভাতে আঙুল নাড়ছেন। তারপর গ্লাস থেকে একটু পানি খেয়ে বললেন, "হঠাৎ কী হলো তোর? বিয়ের কথা আসছে কেন?"
-বিয়ে তোমার আগেই করার দরকার ছিল বাবা। আমি বুঝতে পারিনি। এবার সত্যিই তুমি একটা বিয়ে করো। আমি নিজে যাব সেই বিয়েতে।
-আরে তা আর হয় না-কি? মানুষ কী বলবে? এই বয়সে আর বিয়ের দরকার নেই।
-না বাবা, আমি তোমার কোনো কথা শুনব না। বিয়ে তোমাকে করতেই হবে।
-তোর যে রঙ এর কথা!
কথাটুকু বলে বাবা তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে উঠলেন। অন্যসময় হলে বাবা নিশ্চয় আরেকটু ভাত নিতেন। বিয়ের কথা শুনে বাবা কি কিঞ্চিত লজ্জা পেলেন? হতেও পারে। মনুষ্য মনে আনন্দ-বেদনা, ভয়, হতাশার মতো লজ্জা থাকাটাও স্বাভাবিক। আমার ফোন বেজে উঠল। শ্বশুর ফোন করলেন। আমি রিসিভ করে সালাম দিলাম। তিনি বললেন, "বাবা, তুমি একটু আমাদের বাসায় আসো তো। খুবই জরুরী।"
আমি আসছি বলে ফোন রাখলাম। ভাবছি কী এমন জরুরী তলব! তানহা কি আসতে রাজী হয়েছে শেষ পর্যন্ত?
*
পুকুরে বড়শি পেতে বসে আছেন শ্বশুর। আমি গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি পাশের চেয়ারে ইশারা করে বসতে বললেন। চেয়ারটি মনে হয় তিনি আগেই এখানে এনে রেখেছেন। ছোট্ট একটি লাল বালতি রাখা পাশে। কিন্তু কোনো মাছ ধরা পড়েনি এখনো। আমি ভাসমান ছোট্ট কাঠির দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকালাম। মনে হচ্ছে পুঁটি মাছ ঠোকরাচ্ছে। কাঠি পানির নিচ দিকে গেলেই তিনি বড়শি টেনে তুলবেন।
"আসলে বাবা তোমাকে যে কারণে ডেকেছি। তানহার সাথে সকালে কথা বললাম। বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।"
আমি উনার কথায় মনোযোগ দিলাম। তিনি এবার বলতে লাগলেন,
"তানহার খালাকে আমি সবসময় নিজের বোন মনে করতাম। তানহার মা যখন ওর বোনকে প্রথম এই বাড়িতে নিয়ে আসে। সেদিন সে বলেছিল, 'ভাই আমার কোনো ভাই নেই। আপনিই আমার ভাই।' তানহার কোনো মামা নেই। যাই হোক, তুমি মনে হয় তানহার খালাকে বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু বলেছো। সে আমাকে কিছু বলেনি। তানহাকে বিষয়টা জানিয়েছে। বলেছে, 'তানহা এবার তুই আর রাগ করে থাকিস না। শাওনদের বাড়িতে যা। তোকে না পেয়ে সে খুব একা। এমনকি এই বয়সে আমাকে তার বাবার সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছে। তুই আর রাগ করে না থেকে শাওনকে ফোন করে তার সাথে যা।' তানহা উত্তেজিত হয়ে বলল, 'মা এটা আমিও চাই। তোমাকে ছাড়া ঐ বাড়িতে একা একা লাগে। তুমি রাজী হয়ে যাও মা, আমি বাবার সাথে কথা বলি।' তানহার খালা বলেছে, 'এই বয়সে আমার এত রঙ নাই। সন্তান না হওয়ার জন্য সংসার ভাঙল। এই বয়সে আবার সংসার!' তানহা তার খালাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, 'এটাই তো ভালো হয়েছে মা, আমার কোনো ভাই বোন হবে না, সব আদর আমি পাব।'
সে যাই হোক। তুমি যে এই প্রস্তাব দিয়েছো, তোমার বাবা কিছু জানে?
আমি শ্বশুরের দীর্ঘ কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলাম। নিজের বাবার বিয়ের জন্য একজন নারীকে সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছি। আর সেই বিষয়টা শ্বশুর জেনেছে তানহার মুখ থেকে। আমি বললাম, 'বাবাকে বলেছি যে বিয়ে করার জন্য। আমি পাত্রি দেখব। কিন্তু পাত্রি যে এই বাড়িতে, এটা বাবা জানেন না। সমস্যা নেই, বাবাকে রাজী করানোর দায়িত্ব আমার। কিন্তু মা রাজী হয়েছে তো?'
শ্বশুর মশাই বড়শি টানলেন। মাছ বড়শিতে লেগে একটু উপরে উঠে আবার টোপ করে পড়ে গেল। বড়শি কাছে এনে খাবার লাগিয়ে আবার পানিতে ফেললেন। তারপর বললেন, "আমি আর তানহা বললে রাজী না হয়ে পারবে না। তুমি তোমার বাবার সাথে কথা বলো।"
-ঠিক আছে।
-আচ্ছা যাও এবার ঘরে। আমার সাথে কথা হয়েছে, এসব যেন তানহার খালা বুঝতে না পারে। তানহার সাথে এখন কথা বলতে পারো, ওর রাগ মনে হয় একটু কমেছে।
তানহা ছাদে দাঁড়ানো। আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। আমার উপস্থিতী টের পেয়ে তানহা নিচে নামতে চাইলো। আমি দ্রুত বললাম, "থামো। মায়ের বিষয়ে একটু কথা বলি।"
-সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি গিয়ে বাবার সাথে কথা বলো। আর খালার বিয়ে হবে বলে ভেবো না আমিও তোমার বাড়িতে যাব। আমি আর যাব না।
-অনেক হয়েছে তানহা। মানুষ শুনলে হাসাহাসি করবে। একজন মানুষের এই যুগে সম্পর্ক থাকতেই পারে। তুমি তো কোনোদিন জানতে চাওনি আমার সম্পর্ক আছে না-কি! আমিও ইচ্ছে করে বলতে যাইনি। হঠাৎ শুনে তোমার অভিমান হতেই পারে। তাই বলে আমার বাড়িতে যাবে না তুমি। এমন বড়ো কিছু তো হয়নি। সম্পর্ক নিশ্চয় এত ঠুনকো নয়।
তানহা কিছু না বলে ছাদ থেকে নেমে গেল। তবে তার মন যে কিছুটা গলেছে সেটা বুঝা যাচ্ছে।
*
এক সপ্তাহ পর বাবার সাথে তানহার খালার বিয়ে হলো। আমাদের এখান থেকে চার পাঁচজন গিয়েছিলাম। ওখানকারও দুই চারজন উপস্থিত ছিল। ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ে হলো। বাবার বিয়ের দিন আমি আমার শ্বশুরের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, "নিঃসঙ্গ জীবন কাটানোর চেয়ে, আপনিও একটি বিয়ে করে নেন।" আমার কথা শুনে তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। ঘরের বইগুলোর দিকে আঙুলে ইশারা করে বললেন, "আমাকে তোমার নিঃসঙ্গ মনে হয়? বউ অথবা বই যেকোনো একটা সাথে থাকলে তুমি কখনো নিঃসঙ্গ হবে না।"
এই বিয়ে নিয়ে মিতু প্রথমে রাজী ছিল না। যদিও প্রথমবার তো আমিই মিতুকে ফোন করে ডেকে এনেছিলাম বাবার বিয়ে বন্ধ করার জন্য। আবার সেই আমি বিয়ের ব্যবস্থা করেছি দেখে মিতু কিছুটা অবাক হলেও শেষ অবধি রাজী হয়েছে। যদিও মিতুর রাজীতে কোনোকিছু যায় আসে না। বাবা যেন তরুণ বর এর মতোই লাজুক। আমার চোখে চোখ পড়তেই অন্যদিকে তাকিয়ে ফেলে। আর ঠোঁটের কোনে প্রশান্তির মুচকি হাসি। সবই ঠিক আছে, সমস্যা শুধু একটাই। তানহা এতকিছুর পরও আমার সাথে আমাদের বাড়ি আসেনি। মুখ উলটিয়ে বলেছিল, "দেখি তোমার বাড়ি না গেলে কী হয়।"
কিন্তু আজ তানহার আগমন দেখে কিছুটা অবাক হতে হলো।
আমাকে খবর না দিয়ে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বাড়ির উঠানে এসে উপস্থিত। মা ঘর থেকে বের হয়ে তানহাকে জড়িয়ে ধরলেন। তানহার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুমি ভেবো না তোমার কাছে এসেছি। আমি মায়ের কাছে এসেছি।"
আমি আর কিছু বলিনি। মনে মনে ওর অজুহাত দেখে হাসি পেল। যখন ঘরে চলে যাচ্ছিলাম, তখন তানহা মা'কে বলল, "মা, তোমার ছেলেকে বলো আমাকে যেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তুমি মনে হয় নানি হবে।"
আমি থমকে দাঁড়ালাম। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি তানহার চোখে মুখে খুশির জোয়ার। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকি দিয়ে বুঝাচ্ছে, ঘটনা সত্যি।
বাবা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। আমাদের আনন্দে তিনিও শরীক হলেন। এখন আর আমরা কেউ একা নই। আমি একা নই। বাবা আর একাকীত্বের দিন গুনেন না। আমাদের চারজনের পরিবারে আরো একজন অতিথী আসবে। এই খুশি যেন এমনি করে সবসময় থাকে আমাদের জীবনে।
.....সমাপ্ত
লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,,,,
,,,,,,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ