গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে বাবার আপত্তি | Father objected to the yellow ceremony
শোনো সুমাইয়ার বাবা,আজকের আধুনিক যুগের আধুনিক সমাজের আধুনিক ছেলেমেয়েরা এসব একটু আধটু করবেই।যুগের সাথে,সমাজের সাথে তো তাল মিলিয়ে চলতে হয়।ফলে সবকিছুতে বাঁধা দিতে নেই।ওরা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছে করুক।তাছাড়া,সামান্য গায়ে হলুদে কী আর এমন ক্ষতি হয়ে যাবে,একদিনই তো করছে।
--তুমি এ কী বলছো,ফাতেমা?তুমি কি বুঝতে পারছো, তুমি কতো বড়ো কথা বলে ফেলেছো,কতো বড়ো অন্যায় করে ফেলেছো?
--কেনো?আমি আবার কোথায় এতো বড়ো কথা বলে ফেললাম?কী এমন অন্যায় করে ফেললাম?
--আচ্ছা,কোনো মানুষ যদি আল্লাহর বিধানকে ছোট করে দেখে,অবজ্ঞা করে এমনকি আল্লাহর বিধানের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজে থেকে কিছু বলে তবে সেটিকে তুমি কিভাবে দেখবে?
--আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।হঠাৎ করে তুমি এমন প্রশ্ন করছো কেনো?আমি তো আল্লাহর বিধান নিয়ে কিছু বলি নি।
--ফাতেমা,আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
--একজন সাধারণ মুসলিমা হিসেবে আমি বলবো, আল্লাহর বিধানকে ছোটো করে দেখা অবশ্যই একটি অন্যায় কাজ।আর আল্লাহর বিধানের ওপর মন্তব্য করা সে তো মহা অন্যায় কাজ।এতো বড়ো দুঃসাহস কোনো মুসলিমের আছে নাকি?
--আছে কি-না তা পরে দেখা যাবে।যাইহোক,তুমি তাহলে এ বিষয়টি বুঝতে পেরেছো।এবার আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনো।প্রথমত,আল্লাহর হুকুম রক্ষা করে কেবল শরীরে অর্থাৎ গায়ে হলুদ মাখামাখিতে কোনো সমস্যা না থাকলেও গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান পালন করা ইসলামে স্পষ্টত নাজায়েজ।কারণ ইসলামে এই ধরণের অনুষ্ঠান পালনের কোনো অনুমোদন নেই।এমন অনুষ্ঠান পালন করা সম্পূর্ণ সুন্নাহ বিরোধী কাজ।অধিকন্তু, এসব অনুষ্ঠানে পুরুষ মহিলার অবাধ বিচরণ থাকে।ফলে মাহরাম,গায়রে মাহরাম তথা আল্লাহর দেওয়া পর্দার ফরয বিধানের চরম লঙ্ঘন হয়। অথচ আল্লাহ তা'য়ালা কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে জোর দিয়ে পর্দার নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন,হে নবী আপনি মু'মিন নারীদেরকে বলুন তারা যেনো (মাহরাম ব্যতীত) তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। [১]
এছাড়া,আল্লাহ তা'য়ালা মু'মিন নারীদের আরও বলেছেন,তোমরা ঘরে অবস্থান করবে-পূর্বেকার জাহেলিয়াতের যমানার (নারীদের) মতো নিজেদের প্রদর্শনী করে বেড়াবে না। [২]
এগুলো হচ্ছে আল্লাহর বিধান।আর ঐসব অনুষ্ঠানে একদিকে যেমন দৃষ্টির হেফাজত করা হয় না তেমনি অন্যদিকে নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকা তো দূরের কথা বরং আরও উন্মুক্তভাবে সৌন্দর্য প্রদর্শন করা হয়।এ যেনো সৌন্দর্য প্রদর্শনের এক আয়োজন।আর তাতে আল্লাহর নির্দেশ চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়।
এখন এই যে তুমি বললে আধুনিক যুগের আধুনিক সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তাহলে আল্লাহ যখন উনার এসব বিধানসমূহ চালু করেছিলেন তখন কি আল্লাহ তা'য়ালা জানতেন না যে,আধুনিক যুগ বলে একটি যুগ আসবে?তোমার কথায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে,আল্লাহর বিধান যেনো আজকের এই যুগের জন্য কার্যকরী নয়।তুমি এমনভাবে বললে যেনো আধুনিক যুগের জন্যও আল্লাহর বিধানও নতুন রূপে সাজাতে হবে সর্বোপরি আধুনিক হতে হবে।নাউজুবিল্লাহ!
তোমার কথায় মনে হচ্ছে,তুমি আল্লাহর বিধানকে আধুনিক মনেই করছো না অথচ আল্লাহর দেওয়া প্রত্যেকটি বিধানই আধুনিক এবং কিয়ামত পর্যন্ত আধুনিকই থাকবে।আল্লাহর বিধানকে আধুনিক মনে না করা কুফরির শামিল।ঈমান হারানোর জন্য আল্লাহর দেওয়া বিধানকে সেকেলে মনে করাই যথেষ্ট।
দুঃখজনক হলেও সত্য,আজকের যুগে নগ্নতাকেই আধুনিকতা বলা হয়।বড়ো নির্লজ্জের মতো ছেলে মেয়ে একে অপরের হাতে হাত রেখে সবার সামনে ঘুরে বেড়াবে,উন্মুক্তভাবে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলবে,একে অপরের প্রতি চোখের যিনা তথা ক্রাশ খেয়ে বেহায়ার মতো যততত্র বলে বেড়াবে, বড়ো-ছোটো মানবে না,প্রকাশ্যে স্মোকিং করবে, ক্যাডারি করে বেড়াবে- এগুলোই হলো আজকের যুগের আধুনিকতার নমুনা।
এবার তোমার ঐ কথায় আসি।তুমি যে বললে আধুনিক যুগে আধুনিক সমাজের আধুনিক ছেলেমেয়েদের বিয়েতে গায়ে হলুদের মতো অনুষ্ঠান একটু-আধটু হয়।এ কথার অর্থ কী দাঁড়ায়,জানো?এ ভয়ঙ্কর কথার অর্থ দাঁড়ায়,তুমি আধুনিকতার দোহাই দিয়ে আল্লাহ তা'য়ালার হুকুম লঙ্ঘিত হয় এমন কাজে সম্মতি প্রকাশ করলে।আর তাতে তুমি আল্লাহর বিধানকে তুচ্ছ করলে,অবজ্ঞা করলে।অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের ঊর্ধ্বে গিয়ে তুমি আধুনিকতাকে এবং সমাজকে প্রাধান্য দিলে।আর এটা যে কতো বড়ো অন্যায়, কতো বড়ো ধৃষ্টতা সেটা কি তুমি বুঝতে পারছো?
এছাড়া,তুমি বলেছো,একদিনই তো করছে।আর এর মানেটা কী?তবে কি তুমি এটা বোঝাতে চাচ্ছো যে,আল্লাহর বিধান একদিনের জন্য হলেও লঙ্ঘন করা যায়?এরূপ বলাতে কি আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনের প্রতি লঙ্ঘনকারীদের এক ধরণের উৎসাহ দেওয়া হয়ে যায় না?মনে হচ্ছে, আধুনিক যুগে তুমি আল্লাহর এইসব বিধানকে মানতেই পারছো না।আর এমনটাই তো তোমার বলা কথায় ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
অন্যদিকে,তুমি আরও বলেছো,ছেলেমেয়েদেরকে ওসবে বাঁধা দিতে নেই।ওসবে বাঁধা দিতে নেই-এর মানেটাও কী?আর ওসবটা আসলে কী?ওসব তো হচ্ছে মাহরাম,গায়রে মাহরাম তথা পর্দার ফরয বিধানকে ভঙ্গ করে ছেলেমেয়েদের অবাধ বিচরণ,ওসব তো হচ্ছে গান-বাজনা,সৌন্দর্য প্রদর্শন বা ফ্যাশন শো, হাসি- তামশা ইত্যাদির জমজমাট এক আড্ডা।ওসব তো হচ্ছে অমুসলিমদের সংস্কৃতি অনুসরণ,ওসব তো হচ্ছে এমন অনুষ্ঠান যার অস্তিত্ব ইসলামে নেই।সর্বোপরি, ওসব তো হচ্ছে সম্পূর্ণ আল্লাহর হুকুম বিরোধী কর্মকান্ড।তার মানে তোমার ঐ কথার অর্থ স্পষ্টরূপে এরূপ দাঁড়ালো যে,আল্লাহর হুকুম বিরোধী কর্মকান্ড করতে তাদেরকে বাঁধা দিতে নেই।নাউজুবিল্লাহ! কত্তো বড়ো কথা তা কি ভাবা যায়,ফাতেমা?
যেহেতু ওরা যা করতে যাচ্ছে তাতে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই সেহেতু তোমার বলা ঐ কথাটি অর্থাৎ 'ওরা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছে করুক' এর আসল অর্থই তো হচ্ছে ওরা আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করছে করুক।নাউজুবিল্লাহ!এই কথার দ্বারা আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে তুমি তাদেরকে সমর্থন করছো,উৎসাহ দিচ্ছো,শিথিলতা অবলম্বন করছো।নতুবা তুমি কথাটি একদম অনায়েসেই ওভাবে বলতে পারতে না,ফাতেমা।আর এ ধরণের কথাতে কতো বড়ো ধৃষ্টতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে তা কি তুমি উপলব্ধি করতে পারছো?অথচ তুমিই বলেছিলে আল্লাহর বিধানের উপর মন্তব্য করার মতো বড়ো দুঃসাহস কোনো মুসলিমের আছে নাকি?এখন তুমিই বলো,তোমার ঐ মন্তব্য অর্থাৎ 'তারা যা করছে করুক' এমন মন্তব্যতে কি তুমিই সেই দুঃসাহসিক মুসলিমের পরিচয় দেও নি?তুমিই তো সেই দুঃসাহস দেখিয়ে দিলে।তাই না?
--তোমার বলা কথাগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।আসলে বিষয়টি তো আমি ওভাবে চিন্তা করে বলি নি তাই অনেকটা অসচেতন ভাবেই বলে ফেলেছিলাম।
--কেনো চিন্তা করে কথা বলবে না,ফাতেমা? এগুলো তো চিন্তা করেই বলার বিষয়।একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রতিটি কথাই চিন্তা করে বলতে হবে যাতে আমাদের বলা কথাগুলো আল্লাহর বিধানের বিপক্ষে অবস্থান না করে, রাসূল (সাঃ) এর আদর্শের বাইরে চলে না যায় সর্বোপরি নিজে ঈমানহারাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে না যাই।আর ঈমানই যদি নাই-বা থাকলো তবে মুসলিম হয়ে কী লাভ হলো?
--হ্যাঁ,ঠিকই বলেছো।এগুলো সত্যিই চিন্তা করে বলার বিষয়।এখন বুঝতে পারছি,আমার ওভাবে বলা মোটেও উচিত হয়নি।যাইহোক,আমি এখন চিন্তা করছি,তোমার মেয়ে কি এগুলো বুঝবে?
--কেনো বুঝবে না?আমরা বোঝাই না তাই তারাও বুঝে না।আল্লাহর হুকুম আহকাম মানার ক্ষেত্রে সন্তানের প্রতি আমাদের উদাসীনতাই প্রকটভাবে দায়ী।এ দায় কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না।আসলে,প্রথম দোষটাই কিন্তু আমাদের নিজেদেরই।আমরাই ওদেরকে এই পরিবেশের সাথে ছোট থেকে অভ্যস্ত করে তুলেছি।আজ যদি আমরা শুরু থেকেই তাদের নিকট ইসলামের সৌন্দর্যের কথা তুলে ধরতাম,কেনো এ ধরণের অনুষ্ঠান পালন করা ইসলামে জায়েজ নেই তার কারণ বুঝিয়ে আসতাম সর্বোপরি তাদেরকে ইসলামিক পরিবেশের মধ্যে রাখতাম তবে তারা নিজেরাই এসব অনুষ্ঠান পালন থেকে সরে আসতো,এগুলো অনায়সে বর্জন করতো।
অবশ্য এটা ঠিক যে,আজকের মতো আমিও তো আগে ওভাবে দ্বীনের সংস্পর্শে ছিলাম না।ফলে তাদেরকে ছোটো বেলা থেকে ঐ পরিবেশে রাখতে পারিনি।বাবা হিসেবে এটা আমারও অনেক বড়ো একটি ব্যর্থতা যা এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।সেজন্য আমার খুব অনুতাপও হয়।দোয়া করি,মহান আল্লাহ তা'য়ালা যেনো আমাকে এবং আমাদের সবাইকে মাফ করে দেন।
--আমিন!আসলে,এ ব্যাপারে আমাদের গাফিলতিকে কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যাই না।আমরাই তাদেরকে ছোটো থেকে এগুলো বুঝিয়ে আসি না বরং এসব অনুষ্ঠানে তাদেরকে উপস্থিত করে তাদের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেই।ফলে তারাও আর পরবর্তীতে তাদের সময়ে এসে এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। এমনকি তাদেরকে শত বোঝালেও সহজে বুঝতে চায় না।কারণ ঐ যে তুমি যেটা বললে, তাদেরকে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে।যাইহোক, আমাদের মেয়ের ব্যাপারে কী যে করি তা বুঝতে পারছি না!
--কী আর করবে!আমাদেরকে যেভাবেই হোক তাকে বোঝাতে হবে।বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বললে অবশ্যই সে বুঝবে।ইন শা আল্লাহ!তাছাড়া, সুমাইয়া আমার একমাত্র মেয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে।তাই বলে আমি আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করতে পারি না এবং অধীনস্থ হিসেবে তাকেও তা লঙ্ঘন করতে দিতে পারি না।কেননা মৃত্যুর পর প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।তখন আল্লাহর নিকট আমি কী জবাব নিয়ে হাজির হবো,বলো?তখন কি আমি আল্লাহর সামনে জবাব দিতে না পারার কারণে অপমানিত হবো না?আর তখন আমার অপমান দেখে যাওয়া কি তোমাদের মা ও মেয়ের সহ্য হবে?
তুমি কি জানো,রাসূল (সাঃ) বলেছেন,তিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করেছেনঃ
১) যে মদ তৈরী করে।
২) যে মাতা-পিতার নাফরমানী করে এবং
৩) দাইয়্যূস। [৩]
আর ঐ ব্যক্তিকে "দাইয়ুস" বলে-যে তার স্ত্রী'কে ও পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে অশ্লীল কাজ ও ব্যভিচারের সুযোগ করে দেয় এবং সকল শরীয়াহ বিরোধী কাজকে মেনে নেয়।এমনকি যদি এসব কাজে মৌন সম্মতিও থাকে তবুও দাইয়্যূসের অন্তর্ভুক্ত হবে।অতএব,”দাইয়্যূস" কবিরা গুনাহকারী এবং জাহান্নামী"।
এখন তোমরা কি চাইবে তোমাদের কর্মকান্ডের কারণে আমার জান্নাত হারাম হয়ে যাক যেখানে আমি তোমাদের সবাইকে নিয়েই জান্নাতের মতো চিরস্থায়ী স্থানে থাকার স্বপ্ন বুকে লালন করছি?
--তুমি এসব কী বলছো,ফাতেমার বাবা!আমরা কোনোভাবেই আমাদের কর্মকান্ডের কারণে তোমাকে জাহান্নামী হতে দিতে পারি না।আর এ তো দেখছি, অনেক ভয়ানক একটি হাদীস।এখানে আমাদের জন্য কঠিন সতর্কবার্তা রয়েছে।
--এ তো গেলো কেবল একটি কঠিন হাদীসের কথা।এবার তোমাকে আরেকটি মারাত্মক হাদীসের কথা জানিয়ে রাখি।গায়ে হলুদের মতো যতো ধরণের বিজাতীয় অনুষ্ঠান রয়েছে অর্থাৎ যেসব অনুষ্ঠান ইসলামের মধ্যে নেই বরং অমুসলিমদের কাছ থেকে আমদানি করা হয়েছে সেসব অনুষ্ঠান পালন করতে রাসূল (সাঃ) কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।রাসূল (সাঃ) বলেছেন,যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে,সে তাদের দলভুক্ত গণ্য হবে। [৪]
যেহেতু গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান বিজাতীদের কাছ থেকে আমদানিকৃত একটি অনুষ্ঠান আর সেই অনুষ্ঠান পালন করাতে তাদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করা হয়ে যায় সেহেতু রাসূল (সাঃ) এর এই হাদীস মতে আমরা তাদের দলভুক্ত হয়ে যাব। চিন্তা করেছো,কি ভয়াবহ সতর্কবার্তা!নিজেদেরকে মুসলিম দাবি করেও যদি আমাদেরকে বিজাতীদের দলভুক্ত হয়ে যেতে হয় তবে এর চেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে?
ফাতেমা,এখন তুমিই বলো,এরপরও আমি কিভাবে আমার সন্তানকে জেনেশুনে এত বড়ো নাফরমানী কাজ করতে দিতে পারি?আল্লাহকে ভয় করতে পারা কোনো মুসলিম কি তার সন্তানকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি রয়েছে এমন কোনো কর্মকান্ড করতে দিতে পারার কথা?
আবার,আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন,হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার- পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো,যার ইন্ধন হবে মানুষ ও প্রস্তর,যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়,কঠোর স্বভাবের ফেরেশতাগণ।তারা আল্লাহ তা'আলা যা আদেশ করেন,তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়,তাই করে। [৫]
এখন বাবা হিসেবে আমার কি উচিত নয় আমার মেয়েকে যেভাবেই হোউক এমনসব কর্মকান্ড থেকে বাঁচিয়ে রাখা যেগুলোর ফলাফল ভয়াবহ জাহান্নাম?আর মা হিসেবে তুমিও কি তোমার মেয়েকে জেনেশুনে আলসেমি করে জাহান্নামের দিকে টেলে দিতে পারো?
--কক্ষণোই না,জাহান্নামের মতো অভিশপ্ত স্থানের কথা ভাবতেই তো আমার গাঁ শিউরে উঠে।আমি আমার মেয়েকে অবশ্যই দায়িত্ব নিয়ে এ বিষয় সম্পর্কে বোঝাবো।
--হ্যাঁ,সেটাই করতে হবে।এখানে তোমাকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানিয়ে রাখি যা তোমার আত্মসম্মানবোধে লাগবে।দেখো ফাতেমা! গায়ে হলুদের সময় তোমার মেয়ে বিভিন্নভাবে সাজুগুজু করে গায়ে সুগন্ধি মেখে কতো পর পুরুষদের সামনে দিয়ে যাবে কিংবা তার আশেপাশে কতো পর পুরুষের যে সমাগম হবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।আর তুমি কি জানো এ বিষয়ে রাসূল (সাঃ) কী বলেছেন?তুমি তা জানতে পারলে রীতিমতো অবাক হবে।
রাসূল (সাঃ) বলেছেন,প্রতিটি চক্ষুই ব্যাভিচারী। আর যে মহিলা সুগন্ধি মেখে পুরুষদের সভায় বা সমাগমে যায় সে এমন অর্থাৎ ব্যাভিচারকারিণী তথা যিনাকারিণী (বেশ্যার মেয়ে)। [৬]
গায়রে মাহরাম অর্থাৎ পর পুরুষের সামনে কোনো নারী সুগন্ধি মেখে গেলে তার প্রতি রাসূল (সাঃ) এতোটাই ঘৃণা প্রকাশ করেছেন যে,তিনি সেই নারীকে বেশ্যা বা যিনাকারিনী হিসেবে আখ্যায়িত করতে দ্বিধা করেন নি।দেখো,পর পুরুষের সামনে সাজুগুজু করে যাওয়া যদি চূড়ান্ত পর্যায়ের খারাপই না হতো তবে রাসূল (সাঃ) এর মতো মানুষ যার কি-না কোমল ভাষায় মুগ্ধ হয়ে অমুসলিমরা পর্যন্ত মুসলিম হয়ে যেতো সেই তিনিই এতোটা কঠিন ভাষায় মন্তব্য করতেন না।এটি আসলেই মারাত্নক পর্যায়ের খারাপ বিধায় রাসূল (সাঃ) এতো কঠোরভাবে কথাটি বলেছেন।
এখন তুমি কি ভাবতে পারছো,এটা কতোটা ঘৃণা বিজরিত কথা?তুমি কি তোমার আদরের মেয়েকে বেশ্যা হিসেবে মেনে নিতে পারবে?পারবে কি নিজেকে বেশ্যার মা হিসেবে মেনে নিতে?আরে, আমার তো এমন বিষয় নিয়ে ভাবতেই লজ্জায় মাথাটা নিচু হয়ে আসছে, আত্নমর্যাদায় চরমভাবে আঘাত লাগছে।এরপরও কি তুমি বলতে পারবে, তারা গায়ে হলুদ করছে করুক?এরপরও কি তুমি তোমার মেয়েকে খুব করে সাজিয়ে সুগন্ধি মাখিয়ে পরপুরুষের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দিতে পারবে?আর নূন্যতম আত্নমর্যাদাসম্পন্ন কোনো মা-বাবা কি তার সন্তানকে তা করতে দিতে পারে?
--সত্যিই তা কতোই-না বড়ো লজ্জার বিষয়! আত্মসম্মানবোধে এর চেয়ে বড়ো আঘাত আর কী হতে পারে?আমি কোনোভাবেই আমার মেয়েকে এমন কোনো কাজ করতে দিতে পারি না যার জন্য আমার মেয়ে রাসূল (সাঃ) এর ঐ ঘৃণিত শব্দের উপযুক্ত হয়ে যায়।
--আলহামদুলিল্লাহ!তুমি তাহলে বুঝতে পেরেছো।
অনেক মা বাবাদেরকে তো এগুলো বোঝালেও বুঝতে চান না।এমনকি তারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেন কিন্তু এসব বিষয় সামনে আসলেই যেনো তারা অন্য রকম হয়ে যান।সন্তানদের বারণ করা তো দূরের কথা পারলে আরও নিজেরাও শামিল হয়ে যান।তখন তারাও সমাজের সাথে,আধুনিকতার সাথে পাল্লা দেওয়া শুরু করেন।আফসোস!এগুলো যে খুবই দুর্বল ঈমানের বহিঃপ্রকাশ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমি একদিকে সালাত,সিয়াম আদায় করতে থাকবো আবার অন্যদিকে আমার সন্তানদেরকে তথা সমস্ত অধীনস্থদেরকে বেপরোয়াভাবে চলতে দেবো,আল্লাহর হুকুম আহকামকে লঙ্ঘন করতে দেবো তবে তো সেটাতে আমার এক ধরণের ভণ্ডামির প্রকাশ পায়।কেননা কোনো প্রকৃত ঈমানদার তার অধীনস্থদের প্রতি উদাসীন থাকতে পারে না,পারে না বেপরোয়াভাবে চলতে দিতে সর্বোপরি পারে না আল্লাহ হুকুম লঙ্ঘন হয় এমন কোনো কাজ করতে দিতে,কিংবা তাতে মৌন সম্মতি প্রকাশ করতে।
এখন হয়তো তুমি বলতে পারো,সমাজের মানুষ তো ওগুলো পালন করছে।শুনো সমাজ কী পালন করছে না করছে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়।আবারও বলছি সেটা মোটেও আমাদের দেখার বিষয় নয়।আর এই সমস্ত বিষয় যখন আমাদের জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে তখন কিন্তু এ সমাজ বাঁচাতে আসবে না।আরে,সাধারণ কোনো বিপদে পড়লেও মানুষজন কাছে না এসে আরও দূরে সরে যায় আবার জাহান্নামের মতো কঠিন মসিবতের সময় বুঝি এরা কাছে আসবে।
প্রত্যেককেই একা একা আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা করতে হবে এবং নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করতে হবে।কাজেই নিজের ভালো মন্দ নিজেকেই বোঝতে হবে,সমাজ বা অন্যেরা কী মনে করছে বা অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল হলে হবে না।একমাত্র ইসলাম কী বলছে সেটির দিকেই আমাদেরকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে।ইসলামকে মানতে গিয়ে সমাজের বিপক্ষে গেলেও আমার কিচ্ছু আসে যাবে না।
সুতরাং ইসলাম বহির্ভূত অপসংস্কৃতি আমার দ্বারা পালন করা কক্ষণোই সম্ভব নয়।এ ব্যাপারে প্রয়োজনে আমি অনেক কঠোরতা অবলম্বন করব কিন্তু তবুও আমি তাতে এক বিন্দুও ছাড় দিতে রাজি নই।তাই আমি বলছি তুমি আমার মেয়েকে সুন্দর করে বোঝাও আর আমিও বোঝাবো।আর মনে রেখো,সমাজ কী বলল সেটা আমাদের নিকট একেবারেই মুখ্য বিষয় নয়,মুখ্য বিষয় হতেও পারে না।বরং আমাদের মুসলিমদের নিকট মুখ্য বিষয় হচ্ছে ইসলাম তথা আল্লাহ কী বলেছেন এবং রাসূল (সাঃ) কী করেছেন।
--হ্যাঁ,খুব সুন্দর বলেছো।এমনি তো হওয়া উচিত।
--তোমাকে আরেকটি কথা বলে রাখি।সমাজের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমাদের মেয়েও হয়তো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান করতে চাইতে পারে।এক্ষেত্রে তুমি তাকে ইসলামের আলোকে বিষয়টি বিনয়ের সাথে বোঝানোর চেষ্টা করো।আজকের সমাজের অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে,অনেক মা বাবাই তাদের সন্তানদের কথার সাথে তাল মিলিয়ে ইসলাম বিরোধী অনেক কার্যকলাপ করে থাকেন।অর্থাৎ সন্তানদেরকে তা করতে বারণ না করে বরং তাদেরকে আরও সমর্থন করেন যা খুবই দুঃখজনক।
পরিশেষে,তুমি কি চাইবে আমার মেয়ের বৈবাহিক জীবনের যাত্রা আল্লাহর নাফরমানী তথা আল্লাহর অবাধ্যতা দিয়ে শুরু হোউক?যে আল্লাহ সুখের মালিক সেই তাকেই যদি অখুশি রেখে কোনো যাত্রা শুরু করা হয় তবে কোন মুখে তার কাছে সুখ আশা করব?তখন কি লজ্জা হবে না?এছাড়া, আজ যদি তুমি মাকে অসন্তুষ্টি রেখে তোমার মেয়ে কিছু করতে যায় তবে কি তাতে আমার ভালো লাগবে?ভালো লাগবে না তো!তদ্রুপভাবে,আমার মালিককে তথা মহা রাব্বুল আলামিনকে যদি অসন্তুষ্ট রেখে আমার সন্তানদের কেউ কিছু করতে যায় তবে কি আমার ভালো লাগার কথা, কোনো ঈমানদারের ভালো লাগার কথা-তুমিই বলো?
--খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কথা।তোমার কথাগুলো আমি ভীষণভাবে উপলব্ধি করতে পারছি।আমি অবশ্যই সুমাইয়াকে বোঝাবো।আমিও এ ব্যাপারে তাকে আর কোনো ছাড় দেবো না।তুমি কোনো চিন্তা করো না।যেভাবেই হোক আমি ওকে বুঝিয়ে এই ধরণের নাফরমানী কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখবো।ইন শা আল্লাহ!
--মা শা আল্লাহ!প্রত্যেক মা-বাবা চাইলেই কিন্তু তাদের সন্তানদেরকে বুঝিয়ে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারেন।কেবল প্রয়োজন তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করে সন্তানদের প্রতি খেয়ালী হওয়া।দোয়া করি মহান আল্লাহ তা'য়ালা যেনো আমাকে তোমাকে এবং আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করেন।সর্বোপরি, হেদায়েত দান করে মৃত্যু অবধি তার উপর অটল থাকার তাওফিক দান করেন।আমিন!
--আমিন!সুম্মা আমিন!
রেফারেন্সঃ
[১] সূরা আন নূর,আয়াত নং : ৩১
[২] সূরা আল-আহযাব,আয়াত নং : ৩৩
[৩] মুসনাদে আহমাদ,হাদীস নং : ৫৮৩৯
[৪] সুনানে আবু দাঊদ,হাদীস নং : ৪০৩১
[৫] সূরা আত তাহরীম,আয়াত নং : ০৬
[৬] আত তিরমিযী,হাদীস নং : ২৭৮৬ ; আবু দাঊদ,হাদীস নং : ৪১৭৩
কিছু কথাঃ
সমাজের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আমরা এমন কিছু অনুষ্ঠান পালন করি যা স্পষ্টত আল্লাহর হুকুমের পরিপন্থী।আমাদের সমাজে বিশেষ করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান খুবই সাধারণ একটি বিষয়ে পরিণত হয়ে গিয়েছে।অথচ ইসলামে এর কোনো অস্তিত্বই নেই।
আমাদের সমাজে অনেকে মা-বাবাই তাদের ছেলেমেয়েদেরকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান পালন করার ক্ষেত্রে সমর্থন দিয়ে থাকেন।অথচ এটি সম্পূর্ণ নাজায়েজ।আমি একদিকে সালাত সিয়াম পালন করতে থাকব আবার অন্যদিকে ছেলেমেয়েদেরকে নাফরমানী কাজ করতে দেব তবে আমি কেমন মুসলিম,কেমন ঈমানদার?তাতে কি আমার ঈমানী আত্নমর্যাদায় লাগার কথা নয়?এসব বিষয়ে আমাদেরকে একটু চিন্তাশীল হতে হবে।এক্ষেত্রে গল্পের বাবা চরিত্র বেশ অনুকরণীয়।
সুতরাং আমাদের উচিত সন্তানদেরকে তাদের ছোটোকাল থেকে এইসব থেকে দূরে রাখা। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে এইসব অপসংস্কৃতি পালনের পরিণাম তাদেরকে বোঝাতে হবে যেনো এসবের প্রতি তাদের শুরু থেকেই আকর্ষণের পরিবর্তে ঘৃণা সৃষ্টি হয়।আর আমরা যদি আল্লাহর প্রতিটি বিধানের প্রতি নিজেরাই সচেতন হতে পারি তবেই আমাদের সন্তানেরাও তাতে সচেতন হবে।ইন শা আল্লাহ!
#গায়েহলুদ
#মেহেদীসন্ধ্যা
Add Comment
comment url